মঙ্গলবার, ০৪ নভেম্বর ২০২৫, ১০:৩৩ অপরাহ্ন

আমের রাজ্যে এখন খেজুর গাছের দাপট

  • আপডেট টাইম : বুধবার, ১ অক্টোবর, ২০২৫, ৯.৩৫ পূর্বাহ্ণ
  • ৫৮ বার

রাজশাহীর চারঘাটের রায়পুরের আলতাফ হোসেন আগে দিনমজুরি করে পাঁচ সদস্যের পরিবারে তিন বেলা খাবার জোগাতেও পারতেন না। তিন বিঘা জমির আমবাগান থেকেও খরচ ওঠানো ছিল কঠিন। পরে বাগানের আইলে আলো চলাচলের জায়গা রেখে তিনি লাগান ৪৮টি খেজুর গাছ। গত বছর গাছগুলো রস সংগ্রহের উপযোগী হয়। এবার ৪৫টি গাছ লিজ দিয়ে পেয়েছেন ৯২ হাজার টাকা। সে আয়ে কিনেছেন একটি অটোরিকশা। আলতাফের ভাষায়, সংসারে এখন সচ্ছলতা ফিরেছে; দুই ছেলে ও এক মেয়ের চাহিদা সহজেই মেটাতে পারছেন।

আলতাফের পথ ধরে আমবাগানের আইলে খেজুর গাছ লাগিয়ে ভাগ্য বদলেছে চারঘাটের রাওথার রফিকুল ইসলামসহ অনেকের। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, রাজশাহীতে খেজুর গাছের সংখ্যা এখন প্রায় ১১ লাখ। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এসব গাছ থেকে রস সংগ্রহ ও গুড় তৈরিতে যুক্ত থাকেন অন্তত ৫০ হাজার মানুষ। গত মৌসুমে উৎপাদিত প্রায় ১০ হাজার টন গুড়ের বাজারমূল্য ছিল প্রায় ২০০ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টদের আশা, এবার উৎপাদন ও বাজার দুটিই আরও বাড়বে।

চাষি রফিকুল ইসলাম বলেন, ৩৮ শতাংশ জমিতে আমের বাগান করেছি। তিন আইলে ২০টি খেজুর গাছ বড় করেছি। সার-কীটনাশক ও পরিচর্যা শেষে আম বিক্রি করে পেয়েছি ১২ হাজার টাকা। লোকসান তিন হাজার টাকা। অথচ বিনা খরচে খেজুর গাছ চার মাসের জন্য লিজ দিয়েছি ১৭ হাজার টাকায়। মনের দুঃখে আমবাগান কেটে অন্য ফসলের আবাদ শুরু করেছি। রফিকুলের কথার সত্যতা পাওয়া গেছে উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্যে। এক বছরে চারঘাট ও বাঘা উপজেলায় আমের বাগান কমেছে প্রায় ২১০ হেক্টর জমির। বিপরীতে বিভিন্ন জমির আইলে বাড়ছে সারি সারি খেজুর গাছ। আমের রাজ্যখ্যাত রাজশাহীতে রাজত্ব করতে চলেছে খেজুর গাছ।

রাজশাহী কৃষি অধিদপ্তরের তথ্য, জেলায় প্রায় ১১ লাখ আট হাজার ১৮টি খেজুর গাছ রয়েছে। নভেম্বরে এসব গাছ থেকে রস সংগ্রহ ও গুড় উৎপাদন শুরু হয়; চলে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। প্রায় ৪৯ হাজার ৭১১ জন রস সংগ্রহ ও গুড় তৈরিতে জড়িত। গত মৌসুমে জেলায় প্রায় ৯ হাজার ৬৪ টন গুড় উৎপাদন হয়।

পুঠিয়ার ঝলমলিয়া গ্রামের গাছি বাহার উদ্দিন নিজের ১৩টির সঙ্গে আরও ৩৫টি খেজুর গাছ লিজ নিয়েছেন। তিনি জানান, চার মাসের মৌসুমে প্রতিটি গাছের জন্য লিজ দিতে হয় ৮০০ টাকা। একটি গাছ থেকে মৌসুমে ২০–২৩ কেজি রস পাওয়া যায়, যা দিয়ে কমপক্ষে ৯ কেজি গুড় তৈরি সম্ভব। গত মৌসুমে তিনি ২০০ থেকে ২৫০ টাকা দরে গুড় বিক্রি করেছেন। বাহার উদ্দিনের হিসাব অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে জেলায় গুড়ের মোট উৎপাদন দাঁড়ায় প্রায় ৯ হাজার ৯৭৩ টন। গড়ে ২০০ টাকা কেজি মূল্য ধরলে রাজশাহীতে প্রায় ১৯৯ কোটি ৪৬ লাখ টাকার বাজার সৃষ্টি হয়েছে। চাষি, গাছি ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ মৌসুমে এই বাজার আরও বড় হবে।

রাজশাহীতে এবার এক হাজার ৬৯৫ কোটি টাকার আম বিক্রি হয়েছে। জেলার প্রধান এ অর্থকরী ফলের পরই পানের বাজার প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার। এখন উঠে আসছে খেজুরের রস ও গুড়। রাজশাহীতে সবচেয়ে বেশি খেজুর গাছ পুঠিয়া, চারঘাট ও বাঘায়– যথাক্রমে পাঁচ লাখ ৭৭ হাজার ১২৫, এক লাখ ৮৪ হাজার ২৭৫ ও এক লাখ ৫৫ হাজার ৯২৫টি। এ ছাড়া বোয়ালিয়ায় ২৪৩, মতিহারে এক হাজার ৫১৮, পবায় ৪০ হাজার ৫০০, তানোরে ১০ হাজার ৭৩২, মোহনপুরে আট হাজার ১০০, বাগমারায় ৩৮ হাজার ৪৭৫, দুর্গাপুরে ৫০ হাজার ৬২৫ ও গোদাগাড়ীতে ৪০ হাজার ৫০০টি।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, পুঠিয়া, চারঘাট ও বাঘার বিস্তীর্ণ এলাকায় গাছিরা খেজুর গাছ পরিষ্কার করে রস সংগ্রহের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। চারঘাটের সরদহ ইউনিয়নের পালপাড়ায় গাছিদের পরিবারের সদস্যরা রসের হাঁড়িতে দড়ি বাঁধছেন; কেউ কেউ আবার মাটি দিয়ে গুড় তৈরির চুলা বানাচ্ছেন। খেজুরের রসকে কেন্দ্র করে পুরো গ্রামের মানুষ কর্মব্যস্ত সময় পার করছেন। পুঠিয়ার দীঘলকান্দি গ্রামের চাষি রুহুল আমিন জানান, তিন বিঘা জমিতে আম ও পেয়ারা চাষ করে লাভ পাননি। তাই ২০০৬ সালে একই জমির তিন আইলে ৬৩টি এবং অন্য দুই ক্ষেতে ৭০টি খেজুর গাছ লাগান। এখন কোনো অতিরিক্ত খরচ ছাড়াই শীতকালে ১৩৩টি গাছের রস থেকে তৈরি গুড় বিক্রি করে বছরে তিন থেকে চার লাখ টাকা আয় করছেন। তাঁর কথায়, পরিবারের সারা বছরের খাবার নিয়েও আর দুশ্চিন্তা থাকে না। চারঘাট উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আল-মামুন হাসান বলেন, এবার ভেজাল গুড় প্রস্তুতকারীদের তালিকা করে স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক নাসির উদ্দিন বলেন, দেশজুড়ে রাজশাহীর গুড়ের যে সুনাম, তা রক্ষায় আমরা চাষিদের নিয়ে ভেজাল প্রতিরোধে কাজ শুরু করেছি। উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা মাঠ পর্যায়ে চাষিদের সচেতন করছেন।

Please Share This Post in Your Social Media

এ ক্যাটাগরীর আরো সংবাদ

Footer Widget

Footer Widget

© 2019, All rights reserved.
Design by Raytahost.com
error: Content is protected !!